বিদেশে ঘুরতে বা চিকিৎসা নিতে গেলে কিংবা ইন্টারনেটের প্রসারের ফলে দেশে বসেই অনলাইনে অন্য দেশের পণ্য বা সেবা কিনতে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবহারের প্রয়োজন হতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বৈদেশিক মুদ্রা হিসেবে বাংলাদেশের মানুষ শুধু মার্কিন ডলার ব্যবহার করে। তবে চাইলে ব্রিটিশ পাউন্ড, ভারতীয় রুপি, রিয়াল, দিনার বা রিঙ্গিতও নেওয়ার বা ব্যবহারের সুযোগ আছে।
বৈদেশিক মুদ্রায় অর্থ পরিশোধ বা ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের দীর্ঘ নীতিমালা রয়েছে। অর্থপাচার, হুন্ডি প্রতিরোধ ও অনানুষ্ঠানিক পন্থায় বৈদেশিক মুদ্রার বহির্গমন রোধে এই নীতিমালা প্রণয়ন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিদেশ থেকে যে কোনো অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা সঙ্গে করে নিয়ে আসা যায়। তবে নির্ধারিত সীমার অতিরিক্ত অর্থ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রা অ্যাকাউন্ট খুলে জমা রাখতে হয়। আর অর্থ পরিশোধের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারিত সীমা আছে।
বিদেশ ভ্রমণে নগদ ডলার: যে কাজেই হোক, বিদেশ ভ্রমণের সময় আপনি সর্বোচ্চ কত ডলার নিতে পারবেন, সেটি জেনে রাখা ভালো। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, বিদেশ ভ্রমণের সময় জনপ্রতি সর্বোচ্চ ১২ হাজার ডলার বিদেশে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি আছে। তবে এর পুরোটা নগদ বা নোট আকারে নেওয়া যাবে না। নগদ বা নোট আকারে জনপ্রতি একবারে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার ডলার নেওয়া যাবে। চাইলে বাকি সাত হাজার ডলার পর্যন্ত অর্থ ইন্টারন্যাশনাল কার্ডের মাধ্যমে নেওয়া যাবে। অর্থাৎ, একজন ব্যক্তি পকেটে করে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার ডলার নিতে পারবেন। পরিবারের দু’জন গেলে পাঁচ-পাঁচ মোট দশ হাজার ডলার নিতে পারবেন।
বিদেশে চাকুরি বা অভিবাসন ইত্যাদি সূত্রে একমূখী বা দ্বিমুখী (ওয়ান ওয়ে বা রাউন্ড) টিকেটে বিদেশগামীদের ক্ষেত্রেও ভ্রমণ কোটার সম্পূর্ণ পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা কেনা যাবে (যেমন-২,০০০ মার্কিন ডলার আগে ব্যবহার করা হয়ে থাকলে পঞ্জিকা বর্ষের অবশিষ্ট অব্যবহৃত ১০,০০০ মার্কিন ডলার একমুখী টিকেটে বিদেশ যাত্রার জন্য কেনা যাবে)
দাপ্তরিক প্রয়োজনে বিদেশ ভ্রমণের জন্য সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত খাতের কর্মকর্তারা সরকার নির্ধারিত হারে এবং পেশাগত/ব্যবসায়িক প্রয়োজনে বিদেশ ভ্রমণের জন্য বেসরকারী খাতের নিবাসী ব্যক্তিরা মাথাপিছু দৈনিক অনধিক ৪০০ মার্কিন ডলার হারে বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয় করতে পারেন
এখানে আরও একটা তথ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, একজন ব্যক্তির জন্য নির্দিষ্ট পঞ্জিকা বছরে নিয়ম অনুসারে সর্বোচ্চ ১২ হাজার ডলার পর্যন্ত এনডোর্স করে নিতে পারবেন। এটা একবার বা বহুবার, যাই হোক না কেন। চাইলে একবার ভ্রমণে ১২ হাজার ডলার খরচ করা যাবে। তবে ওই বছর নিজ খরচে বিদেশ ভ্রমণে যেতে পারবেন না। চিকিৎসা বা শিক্ষার মতো বিশেষ প্রয়োজনে বেশি পরিমাণ ডলার নেওয়ার প্রয়োজন হলে যৌক্তিক কারণের উপযুক্ত নথি জমা দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিতে হবে। বিষয়টি আরেকটু পরিস্কার করে নেওয়া যাক। ধরুন, কোনো বছরের জানুয়ারিতে আপনি বিদেশ ভ্রমণে গিয়ে মোট পাঁচ হাজার ডলার খরচ করে এলেন। ওই বছর আপনি আরও এক বা একাধিবার বিদেশ ভ্রমণে সঙ্গে সর্বোচ্চ সাত হাজার ডলার নিতে পারবেন। ধরুন, নির্দিষ্ট বছরে দু’বার ভ্রমণে মোট ১১ হাজার ডলার খরচ করেছেন। তৃতীয়বারও যাওয়ার প্রয়োজন এবং এবার দরকার আরও চার হাজার ডলার। অতিরিক্ত তিন হাজার ডলার খরচের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমতি নিতে হবে।
এছাড়া বিদেশে চিকিৎসা বাবদ সর্বোচ্চ ১০ হাজার মার্কিন ডলার সমপরিমাণ অন্যান্য বৈদেশিক মুদ্রা নেওয়া যাবে। তবে এর বেশি যদি প্রয়োজন হয়, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ বাংকের অনুমতি লাগবে।
বিদেশে অধ্যয়ন বাবদ বৈদেশিক মুদ্রা: বিদেশে ভাষা শিক্ষা কোর্সসহ স্বীকৃত সুপরিচিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পেশাগত ডিপ্লোমা, সার্টিফিকেট কোর্স এবং স্নাতক/ স্নাতকোত্তর পর্যায়ে অধ্যয়নের ফি/বেতন ও বিদেশে থাকা খাওয়ার খরচ বাবদ বৈদেশিক মুদ্রা (বিদেশী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যয় প্রাক্কলন মোতাবেক) বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদিত ডিলার ব্যাংক থেকে কেনা যাবে। দূরশিক্ষণ/স্কুল পর্যায়ে অধ্যয়ন বা অন্যান্য ব্যতিক্রমী ব্যবস্থায় পড়াশোনা বাবদ বৈদেশিক মুদ্রা ছাড় বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমতি সাপেক্ষ। এছাড়া বিদেশী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি সংশ্লিষ্ট পরীক্ষাসমূহের আবেদন, রেজিস্টেশন, ভর্তি, পরীক্ষা ফি বাবদ বৈদেশিক মুদ্রা প্রেরণ করা যায়।
বাংলাদেশে আগত অনিবাসী নাগরিকরা যে অনুমোদিত ডিলার ব্যাংক এর কাছে বৈদেশিক মুদ্রা টাকায় ভাঙ্গিয়েছিলেন, সেই অনুমোদিত ডিলার ব্যাংক থেকে অব্যয়িত টাকার অংক বৈদেশিক মুদ্রায় পুনঃরূপান্তর করে সংশ্লিষ্ট অনিবাসী বাংলাদেশ ত্যাগকালে সঙ্গে নিতে পারেন। এছাড়াও বাংলাদেশে আগত অনিবাসী নাগরিকরা তাদের রূপান্তরকৃত টাকা যে কোন লাইসেন্সপ্রাপ্ত মানিচেঞ্জার এর নিকট থেকে নগদায়ন সনদ উপস্থাপন সাপেক্ষে বৈদেশিক মুদ্রায় পুনঃরূপান্তর করতে পারেন। তবে মানিচেঞ্জারের ক্ষেত্রে পুনঃরূপান্তরিত বৈদেশিক মুদ্রার অংক ৫০০ মার্কিন ডলারের বেশি হবে না। উল্লেখ্য, বিমানবন্দরের বহির্গমন লাউঞ্জে অবস্থিত ব্যাংক বুথ হতে বাংলাদেশী টাকা হতে অনধিক ১০০ (একশত) মার্কিন ডলার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রায় পুনঃরূপান্তর করা যায়
বিদেশফেরতের সময় নগদ ডলার: বিদেশে যাওয়ার সময় আপনি যত ডলারই নিয়ে যান না কেন, ফিরে আসার সময় আপনি যে কোনো অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা বা ডলার সঙ্গে করে নগদে বা কার্ডে করে আনতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১০ হাজার ডলার নগদে আনতে কোনো ঘোষণা দেওয়ার দরকার নেই। তবে ১০ হাজার ডলারের বেশি বৈদেশিক মুদ্রা নগদে আনলে এফএমজি ফরমে বন্দরেই ঘোষণা দিতে হয়। এরপর চাইলে সঙ্গে আনা নগদ ডলারের সর্বোচ্চ ১০ হাজার ডলার নিজের জিম্মায় রাখতে পারবেন। বেশি হলে সর্বোচ্চ এক মাসের মধ্যে অনুমোদিত ব্যাংক বা মানি চেঞ্জার প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করে দিতে হবে। তবে চাইলে রেসিডেন্ট ফরেন কারেন্সি ডিপোজিট (আরএফসিডি) অ্যাকাউন্ট খুলে অতিরিক্ত ডলার ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় রাখার সুযোগ আছে। নিজের জিম্মায় ১০ হাজারের বেশি ডলার নগদে সংরক্ষণ করা বেআইনি। ধরা পড়লে জেল, জরিমানা হওয়ার ভয় আছে।
বিদেশ ভ্রমণে বাংলাদেশি টাকা বহন: বিদেশ থেকে ফেরার পর নিজের বাড়ি বা গন্তব্যস্থল পর্যন্ত যেতে টাকার প্রয়োজন। এ বিবেচনায় বিদেশে যাওয়ার জন্য একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা নগদে সঙ্গে করে নিতে পারবেন। আবার ফেরার সময়ও ওই পরিমাণের বেশি টাকা সঙ্গে আনতে পারবেন না।
সম্পত্তি বিক্রির টাকা বৈদেশিক মুদ্রায় বিদেশে নেওয়া যাবে না: বাংলাদেশে নিবাসীরা স্থাবর সম্পত্তি বিক্রয়লব্ধ টাকা বৈদেশিক মুদ্রায় বিদেশে পাঠাতে পারবেন না। বাংলাদেশী টাকা মূলধনী খাতে রূপান্তরযোগ্য ঘোষিত না হওয়ার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের স্থাবর সম্পত্তি বিক্রয়লব্ধ অর্থ বৈদেশিক মুদ্রায় রূপান্তরপূর্বক বিদেশে প্রেরণের সুযোগ নেই
অননুমোদিত প্রতিষ্ঠানে ডলার লেনদেন নয় :বাংলাদেশে ডলার বা অন্য কোনো বৈদেশিক মুদ্রা কেনাবেচা করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন দরকার। ডলার বা বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন করার অনুমোদন নেই- এমন ব্যক্তির সঙ্গে ডলার কেনাবেচা করা অবৈধ। সুনাগরিক হিসেবে সবার উচিত, আইন মেনে বৈধ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ডলার কেনাবেচা করা।
নিবাসী ও অনিবাসী নাগরিকের সংজ্ঞা:
Foreign Exchange Regulation Act, 1947 (সেপ্টেম্বর, ২০১৫ পর্যন্ত সংশোধিত) অনুযায়ী নিবাসী বাংলাদেশী
ব্যক্তির অর্থ-
(১) এইরূপ ব্যক্তি যিনি বিগত ১২ (বার) মাসের মধ্যে ৬ (ছয়) মাস অথবা এর অধিক সময় বাংলাদেশে অবস্থান করেছেন;
(২) এমন ব্যক্তি যিনি ৬ (ছয়) মাসের কম নয় এরূপ সময়কাল নিবাসী অথবা কর্ম ভিসায় অস্থায়ীভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করছেন;
(৩) এমন ব্যক্তি যার বাংলাদেশে ব্যবসা রয়েছে;
(৪) এরূপ ব্যক্তি যার ব্যবসার প্রধান কার্যালয় বাংলাদেশের বাইরে অবস্থিত কিন্তু শাখা অফিস অথবা লিয়াজোঁ অফিস অথবা
প্রতিনিধি অফিস বাংলাদেশে অবস্থিত;
(৫) বিদেশে অবস্থিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কূটনৈতিক, কনস্যুলার ও অন্যান্য প্রতিনিধি অফিস এবং উক্ত অফিসসমূহে
কর্মরত বাংলাদেশী নাগরিকগণ;
(৬) এরূপ ব্যক্তিবর্গ যারা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের চাকুরীতে কর্মরত অথবা ছুটিতে রয়েছেন।
তবে, বাংলাদেশে অবস্থিত বিদেশী কূটনৈতিক প্রতিনিধি অথবা এরূপ প্রতিনিধির স্বীকৃত কর্মকর্তাগণ এবং বাংলাদেশে
অবস্থিত আন্তর্জাতিক চুক্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের অফিসসমূহ এর অন্তর্ভুক্ত হবে না।
উপর্যুক্ত সংজ্ঞার আলোকে বাংলাদেশে নিবাসী হিসেবে গণ্য নয় এমন ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠান অনিবাসী হিসেবে গণ্য হবেন।