প্রত্যেক ফ্রিল্যান্সারের জন্যই পেমেন্ট প্রসেসিং একটা ঝামেলাপূর্ণ কাজ। আপনি যে পেমেন্ট প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করবেন, সেটি আপনার আর্থিক সীমাবদ্ধতা ও মনদণ্ডের মধ্যে থাকা জরুরী, পশাপাশি আপনার ক্লায়েন্টের জন্যও যাতে সেই ফ্ল্যাটফর্ম ব্যবহার সহজলভ্য হয়, সেটিও গুরুত্বপূর্ণ। এই দুয়ের সমন্বয় করেই একজন ফ্রিল্যান্সারকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
এই লেখায় আমরা পেওনিয়ারকে একটি কেস স্টাডি হিসেবে বিশ্লেষণ করব। পেমেন্ট মেথড হিসেবে লেনদেনের ফি, বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্যতা, প্রসেসিং স্পিড এবং একাধিক মুদ্রায় লেনদেনের অপশন ইত্যাদি নানা মানদণ্ডে এর সুবিধা ও অসুবিধাগুলো কী কী, তা আলোচনা করব।
পেওনিয়ার কি?
পেওনিয়ার হচ্ছে একটি ফিনটেক সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান যার মাধ্যমে অর্থ স্থানান্তর ও ই-কমার্স পেমেন্ট সলিউশন পাওয়া যায়। মার্কিন ডলার, ইউরো, পাউন্ডসহ অনেকগুলো আন্তর্জাতিক মুদ্রায় ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক পেমেন্ট নেওয়া যায় পেওনিয়ারের মাধ্যমে। সারা বিশ্বের ক্লায়েন্টদের কাছ থেকে পেমেন্ট গ্রহণ করার জন্য ফ্রিল্যান্সারদের কাছে এই প্ল্যাটফর্মটি খুবই জনপ্রিয়। নিংঃসন্দেহে এটা বলা যায় যে এখানে ফ্রিল্যান্সারদের জন্য বেশ কিছু সুবিধা আছে। তবে অসুবিধাও আছে।
ফ্রিল্যান্সার হিসেবে পেওনিয়ার ব্যবহারের সুবিধা
ফ্রিল্যান্সিং জগতে পেওনিয়ার একটি পরিচিত নাম। বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য সুবিধা উপভোগ করা যায় এখানে। যেমন-
১. বিশ্বব্যাপী পরিচিতি ও গ্রহণযোগ্যতা
পেওনিয়ারের মাধ্যমে বিশ্বের দুইশটিরও বেশি দেশ ও অঞ্চল থেকে পেমেন্ট গ্রহণ করা যায়। ফলে সারা বিশ্বের ফ্রিল্যান্সারদের জন্য এটি একটি খুব দারুণ অপশন।
যুক্তরাষ্ট্রের একজন ফ্রিল্যান্সারের কথা চিন্তা করুন, যিনি ইউরোপ, এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকার ক্লায়েন্টের জন্য কাজ করেন- তিনি খুব সহজেই নিজের মুদ্রায় পেমেন্ট নিতে পারবেন। তাকে মুদ্রা পরিবর্তনের জন্য বাড়তি খরচ করতে হবে না।
২. অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বীর তুলনায় পেওনিয়ারের লেনদেন ফি কম
পেওনিয়ারের ট্র্যাঞ্জাকশান ফি প্রতিদ্বন্দ্বী অন্যান্য কোম্পানির তুলনায় কম। ফলে যারা বড় আকারের পেমেন্ট গ্রহণ করেন, তাদের জন্য এটি খুবই ভালো অপশন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পেওনিয়ারের চার্জ ২ শতাংশ থেকে শুরু করে ফ্ল্যাট ১.৫ মার্কিন ডলার/পাউন্ড/ইউরো। একজন ফ্রিল্যান্স লেখক যিনি প্রতি মাসে একাধিক ক্লায়েন্টের কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ করেন, তিনি পেওনিয়ার ব্যবহার করে লেনদেনের ফিতে যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় করতে পারেন।
৩. অনেকগুলো মুদ্রায় লেনদেনের সুবিধা
পেওনিয়ারে একাধিক মুদ্রায় লেনদেন করা যায়। ফলে যারা বিভিন্ন দেশের ক্লায়েন্টদের সাথে কাজ করেন, তাদের জন্য খুবই সহায়ক । জাপান, জার্মানি এবং মেক্সিকোর ক্লায়েন্টদের সাথে কাজ করা ফ্রিল্যান্সাররা ইয়েন, ইউরো এবং পেসোতে পেমেন্ট পেতে এবং মুদ্রা রূপান্তর খরচ এড়াতে পেওনিয়ার ব্যবহার করতে পারেন।
৪. বিরোধ নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া দ্রুততর
বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য পেওনিয়ারের একটি নিবেদিত দল রয়েছে। তারা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গ্রাহকের বিরোধ নিষ্পত্তিতে কাজ করে। কোনো কারণে পেমেন্ট আটকে গেলে পেওনিয়ারে তুলনামূলক দ্রুত সময়ের মধ্যে সমস্যা সমাধান করতে পারবেন এবং পেমেন্ট রিসিভ করতে পারবেন।
আবার পেওনিয়ারের বিরোধ নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া ব্যবহার ও বোঝা তুলনামূলক সহজ, যা ফ্রিল্যান্সারদের জন্য ইতিবাচক। অন্যান্য প্ল্যাটফর্মের তুলনায় প্রক্রিয়া সহজ ও স্পষ্ট হওয়ায় পেওনিয়ারে স্ক্যামারদের ফাঁদে পড়ার সম্ভাবনা কম।
৫. অ্যাকাউন্ট খোলা সহজ
ফ্রিল্যান্সার হিসেবে আপনার পেওনিয়ার অ্যাকাউন্ট সেট আপ করা বেশ সহজ। পেওনিয়ারের ইন্টারফেস ব্যবহারকারী-বান্ধব। ফলে যেকোনো নতুন ফ্রিল্যান্সারও কয়েক মিনিটের মধ্যে অ্যাকাউন্ট খুলতে ও পেমেন্ট গ্রহণ করতে পারবেন। আবার অ্যাকাউন্ট খুলতেও সাধারণ কিছু তথ্য প্রয়োজন, অনেকে বেশি তথ্য দেওয়ার প্রয়োজন নেই।
অ্যাকাউন্ট খোলার পরই আপনি ক্লায়েন্টের কাছে ইমেইলের মাধ্যমে পেমেন্ট রিকোয়েষ্ট পাঠাতে পারবেন। এছাড়া তাদের ওয়েবসাইটে বিভিন্ন ফিচার ও সেবার ব্যবহার সম্পর্কে অনেকগুলো টিউটোরিয়াল আছে।
পেওনিয়ারের সহজ সেট আপ প্রক্রিয়া ফ্রিল্যান্সারদের জন্য একটি প্লাস পয়েন্ট। যারা অনলাইনে পেমেন্ট গ্রহণে নতুন বা ব্যস্ততার কারণে জটিল নিবন্ধন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় নেই, তাদের জন্য এটি খুব ভালো অপশন।
৬. পেওনিয়ার নিরাপদ
ফ্রিল্যান্সার হিসাবে পেওনিয়ার ব্যবহারের আরেকটি বড় সুবিধা হল এর কঠোর জালিয়াতি বিরোধী সুরক্ষা। পেওনিয়ার তার ব্যবহারকারীদের জালিয়াতি এবং অননুমোদিত লেনদেন থেকে রক্ষা করার জন্য কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে উন্নত জালিয়াতি সনাক্তকরণ অ্যালগরিদম, যার ফলে লেনদেনগুলো টু-ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন এবং এনক্রিপশন দ্বারা সুরক্ষিত।
এসব নিরাপত্তা ব্যবস্থার ফলে ব্যবহারকারীর অ্যাকাউন্ট এবং লেনদেনে অননুমোদিত প্রবেশ রোধ এবং ফ্রিল্যান্সারদের সংবেদনশীল তথ্য সুরক্ষিত রাখা নিশ্চিত করতে সহায়তা করে। প্রতারণামূলক ক্রিয়াকলাপ সনাক্ত এবং প্রতিরোধের জন্য পেওনিয়ার কর্তৃপক্ষ লেনদেনগুলোকে সার্বক্ষণিক নজরদারির আওতায় রাখে।
পেওনিয়ারের কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা ফ্রিল্যান্সারদেরকে এই প্ল্যাটফর্মের প্রতি আস্থাশীল করে তুলেছে। যারা তাদের আর্থিক লেনদেন এবং সংবেদনশীল তথ্য সুরক্ষিত রাখতে চান, তারা এটি ব্যবহার করতে পারেন।
পেওনিয়ার ব্যবহারের অসুবিধা
পেওনিয়ারের বেশ কিছু অসুবিধাও আছে। যেমন-
১. দীর্ঘ ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়া
যেহেতু পেওনিয়ার বিশ্বের প্রায় সব দেশেই বৈধ, তাই এর ভেরিফিকেশন প্রসেস আরও দ্রুততর ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন হতে পারত। যদিও দীর্ঘমেয়াদে এটি ভালো, তারপরও রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়াটি ফ্রিল্যান্সারদের কাছে ঝামেলাপূর্ণ মনে হতে পারে।
২. নিষ্ক্রিয় অ্যাকাউন্টের জন্য চার্জ
নূন্যতম এক বছর নিষ্ক্রিয় থাকলে পেওনিয়ার অ্যাকাউন্টের জন্য নির্দিষ্ট চার্জ দিতে হয়। তবে এই চার্জের পরিমাণ নির্ভর করে অ্যাকাউন্টে কত অর্থ আছে, তার উপর। যদি নিষ্ক্রিয় থাকাকলীন অ্যাকাউন্টে অর্থ থাকে, তাহলে এই চার্জ প্রযোজ্য হবে। কোনো অর্থ না থাকলে চার্জ প্রযোজ্য হবে না।
উদাহরণস্বরুপ, আপনার নিষ্ক্রিয় কাউন্টে যদি ২২ ডলার থাকে, তাহলে ২২ ডলার চার্জ কেটে রাখা হবে। কিন্তু অ্যাকাউন্টে যদি কোনো অর্থ না থাকে, তাহলে কোনো নিষ্ক্রিয় চার্জ নেই। আবার অ্যাকাউন্ট বন্ধের জন্যও কোনো চার্জ দিতে হবে না।
৩. পেমেন্ট পেতে দেরি
ফ্রিল্যান্সারদের জন্য পেমেন্ট পেতে মাঝে মাঝে দেরি হতে পারে। টেকনিক্যাল সমস্যা, ব্যাংক প্রসেসিং সময় অথবা বিভিন্ন বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য এই দেরি হতে পারে।
আবার ক্লায়েন্ট ও ফ্রিল্যান্সারের মধ্যে যদি পেমেন্ট নিয়ে কোনো বিরোধ দেখা দেয়, তাহলে পেওনিয়ার সেই বিরোধ নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত অর্থ আটকে রাখে। এতে ফ্রিল্যান্সারদের পেমেন্ট পেতে আরও দেরি হয়।
যাতে কোনো বিরোধ তৈরি না হয়, সেজন্য পেওনিয়ারের পেমেন্ট গ্রহণের প্রক্রিয়া ভালোভাবে জেনে নেওয়া উচিত।
৪. পেমেন্ট গ্রহণ এবং অর্থ উত্তোলনে ফি
পেওনিয়ার অর্থ গ্রহণের সময় একবার চার্জ কাটে আবার সেই অর্থ স্থানীয় ব্যাংক একাউন্টের মাধ্যমে উত্তোলনের জন্য আরেকবার চার্জ কাটে। এই চার্জ দেশ ও অর্থের পরিমাণের উপর নির্ভর করে।
কিছু কিছু লেনদেনের জন্য এই চার্জ কম হতে পারে। তবে যারা অনেক বড় পরিমাণ অর্থ গ্রহণ করেন, তাদের চার্জ একত্র করলে এর পরিমাণ বেশি হতে পারে।
মুদ্রাভেদেও এই চার্জ ভিন্ন হতে পারে। এতগুলো ভিন্ন ভিন্ন মাণদণ্ড হিসাব করা অনেক সময়ই ফ্রিল্যান্সারদের জন্য কষ্টকর হতে পারে।
৫. অর্থ উত্তোলনের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা
পেওনিয়ার থেকে পেওনিয়ার কার্ডে এবং স্থানীয় ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ স্থানান্তর করা যায়। তবে অনেক সময় দেশ ও অর্থের পরিমাণের উপর ভিত্তি করে সীমাবদ্ধতাও দেওয়া হতে পারে। পেওনিয়ার থেকে সরাসরি ক্যাশ অর্থ উত্তোলন করা যায় না, আবার নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি অর্থও ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে উত্তেলন করা যায় না।