২০২২ সালের শুরু থেকে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান ও নেপালের মুদ্রার মান উল্লেখযোগ্যভাবে কমতে শুরু করে। এর মূল কারণ ডলারের বিপরীতে এসব মুদ্রার বিনিময় হার কৃত্রিমভাবে ধরে রাখা, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ফলে যা সম্ভব হয়েছে। যাই হোক, মুদ্রার অনিবার্য অবমূল্যায়ন স্থগিত করে এই দেশগুলো তাদের অর্থনৈতিক সংকটকে আরও খারাপ করে তুলেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সম্প্রতি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘দুই বছর আগে ডলার যখন শক্তিশালী হচ্ছিল, তখনই বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত ছিল ধীরে ধীরে টাকার অবমূল্যায়ন ঘটানো। কিন্তু তখন তা করা হয়নি। এখন হঠাৎ করে ডলারের দাম ১০৭ টাকা বা তারও বেশি করা হলো, যার সঙ্গে অর্থনীতি খাপ খাইতে পারছে না।’
ভারতের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক অন্যতম থিংক ট্যাংক গেটওয়ে হাউজও সম্প্রতি প্রকাশিত একটি বিশ্লেষণে ঠিক একই কথা বলেছে।
গেটওয়ে হাউজের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান ও নেপাল প্রত্যেকেই সম্প্রতি বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের (ব্যালান্স অব পেমেন্ট) সংকটে ভুগছে। ডলার সংকটের কারণে বাংলাদেশ জ্বালানি আমদানি করতে পারছে না। বৈদেশিক ঋণ শোধের ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কা ইতোমধ্যে দেউলিয়া হয়েছে, পাকিস্তানও দেউলিয়া হওয়ার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে দ্রব্যমূল্য আকাশ ছুঁয়েছে সত্যি, কিন্তু দেশগুলোর বাজে বৈদেশিক মুদ্রা নীতির কারণে এই সমস্যাগুলো অনেকটা স্ব-প্ররোচিতও।
পাকিস্তানি রুপি (পিকেআর), শ্রীলঙ্কান রুপি (এসএলআর) এবং বাংলাদেশি টাকার (বিডিটি) বিনিময় হারের উপর নজর দিলে দেখা যায়, মার্কিন ডলারের তুলনায় এই দেশগুলো লম্বা সময় ধরে একটি নির্দিষ্ট বিনিময় হার ধরে রেখেছিল। তিনটি দেশই জ্বালানি, খাদ্য ও সার আমদানি করে, তাই ‘শক্তিশালী’ বিনিময় হার আমদানিকৃত পণ্যের দাম সীমার মধ্যে রাখতে সাহায্য করেছে। কিন্তু কৃত্রিমভাবে শক্তিশালী বিনিময় হার রপ্তানিকে অপ্রতিযোগিতামূলক করে তোলে এবং এটি মোটেও টেকসই নয়।
এই দেশগুলো থেকে প্রচুর সংখ্যক কর্মী বিদেশে কাজ করতে যায়। ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো বিদেশে অভিবাসী শ্রমিকদের অন্যতম বড় উৎস এবং রেমিট্যান্সের অন্যতম বড় প্রাপক। বিশ্বব্যাংকের ধারণা অনুসারে, ২০২৩ সালে বিশ্বব্যাপী ৮১৫ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্সের ২০% শতাংশ আসবে বিদেশে কর্মরত দক্ষিণ এশীয়দের কাছ থেকে। ২০২১ সালে এই অঞ্চলে রেমিট্যান্স আসে মোট ১৫৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ছিল এই অঞ্চলের জন্য প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই)-এর তিনগুণ। ভারতের তুলনায় পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা রেমিট্যান্সের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল।
রেমিট্যান্স প্রবাহ ভালো থাকায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো বাজারের বাস্তবতার বিপরীতে ‘শক্তিশালী’ বিনিময় হার বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে এবং ধারাবাহিকভাবে সেটাই করে গেছে। এই দেশগুলোতে প্রায়ই দুটি বিনিময় হার থাকে – একটি ‘অফিশিয়াল’ এবং অন্যটি ‘খোলা বাজার দর’ যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে অর্থ প্রেরণকারী প্রবাসীরা তুলনামূলক কম দাম পায়, তাই সরকারকে এই খাতে ভর্তুকি দিয়ে প্রাণোদনা দিতে হয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, প্রণোদনা দেওয়ার পরও ব্যাংকিং চ্যানেলে যে বিনিময় মূল্য পাওয়া যায়, তা খোলা বাজারের তুলনায় কম। এই দুটি বিনিময়ে হারের ব্যবধান যখন অনেক বেড়ে যায়, তখন বৈধ পথে রেমিট্যান্স আসার পারিমাণ কমে যায়। তখন প্রবাসীরা হাওয়ালা (আরব আমিরাতে যা বৈধ) এবং হুন্ডির মাধ্যমে দেশে অর্থ পাঠায়। গত দুই বছর ধরে দক্ষিণ এশিয়ায় ঠিক এটাই হচ্ছে।
২০২১ সালের দ্বিতীয়ার্ধে যখন শ্রীলঙ্কায় অফিশিয়াল এবং খোলা বাজারের বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের পার্থক্য অনেক বেশি হয়ে গিয়েছিল এবং দেউলিয়া হওয়ার সম্ভাবনা প্রকট হয়ে উঠেছিল, তখন দেশটিতে হাওয়ালা, হুন্ডি এবং অন্যান্য অবৈধ পথে অর্থ পাঠানো উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। ওই সময় দেশটিতে বৈধ পথে রেমিট্যান্স আসে মাত্র ২.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা এর আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫০ শতাংশ কম। শ্রীলঙ্কার অন্তত ১০ লাখ প্রবাসী কর্মী আছে। তারা তখন বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানো প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিল, যার ফলে দেশটির দুর্ভাগ্য আরও ত্বরান্বিত হয়েছে। ২০২২ সালের শুরুতেও দেশটিতে এক মার্কিন ডলারের অফিশিয়াল বিনিময় হার ছিল ২০০ শ্রীলঙ্কান রুপি, অথচ খোলা বাজারে বিনিময় হার ছিল আরও অন্তত ২০ শতাংশ বেশি। আর এখন দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার পর দেশটিতে এক ডলারের দাম ৩৬০ শ্রীলঙ্কান রুপি।
শুধু গত বছরই মার্কিন ডলারের বিপরীতে পাকিস্তানি রুপির দাম কমেছে ৪০ শতাংশ। দেশটিতে এখনও ডলারের অফিশিয়াল বিনিময় হারের তুলনায় আনঅফিশিয়াল দাম অনেক বেশি। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাঁচাতে তাই দেশটি বাধ্য হয়ে আমদানি কমিয়েছে, অনেক উৎপাদন বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। ফলে অর্থনীতি আরও ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। ২০২৩ সালের প্রথম প্রান্তিকে দেশটির রপ্তানি কমেছে ১৯ শতাংশ, কারণ রপ্তানিযোগ্য পণ্য প্রস্তুতকারীরা ডলার সংকটের কারণে তাদের উৎপাদিত পণ্যের কাঁচামাল বিদেশ থেকে কিনতে পারছে না। দেশটির রেমিট্যান্স প্রবাহও কমেছে। চলতি অর্থ বছরের প্রথম ১০ মাসে পাকিস্তানে রেমিট্যান্স এসেছে ২২.৭ বিলিয়ন ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় সাড়ে ১৩ শতাংশ কম। বর্তমান রাজনৈতিক সংকট অর্থনৈতিক সংকটকে আরও ঘনীভূত করেছে।
শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশ এখানে কিছুটা দেরিতে হলেও সঠিক পদক্ষেপ নিয়েছে। গত এক বছরে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের বিপরীতে টাকার মান প্রায় ২৫ শতাংশ কমিয়েছে। আইএমএফ-এর কাছ থেকেও ঋণ পেয়েছে বাংলাদেশ। অন্য দুটি দেশের তুলনায় কিছুটা ভালো অবস্থানে থাকলেও বাংলাদেশও বর্তমানে সুবধিাজনক অবস্থানে নেই।
এই দেশগুলো লাখ লাখ প্রবাসী কর্মীদের কাছ থেকে ভালো রেমিট্যান্স প্রবাহের কারণে কৃত্রিমভাবে শক্তিশালী বিনিময় হার বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিল। ফলে মানুষ কৃত্রিমভাবে কিছুটা লাভবান হলেও শেষ রক্ষা হয়নি। ভারতও অবশ্য একই কাজ করেছে। কিন্তু ভারতের রেমিট্যান্স প্রাপ্তির তুলনায় বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে আয় অনেক বেশি। তাই দেশটি আসলে বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতিতে পড়েনি। ভারত তাদের মুদ্রা পর্যায়ক্রমে অবমূল্যায়ন করার কারণেও নেতিবাচক প্রভাব অর্থনীতিতে পড়েনি।