১১ জুলাই ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে রুপির ব্যবহার শুরু করেছে বাংলাদেশ। দেশের শীর্ষ ব্যবসায়িরা এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। এই সিদ্ধান্তের ফলে মুদ্রা রুপান্তরের খরচ বাঁচার পাশাপাশি অনেক সময়ও বাঁচবে বলে আশা করা হচ্ছে। আপাতত রুপিতে লেনদেন হলেও ভবিষ্যতে টাকায়ও লেনদেন করার ইচ্ছা আছে কর্তৃপক্ষের।
ভারতের ইচ্ছাতেই রুপিতে এই বাণিজ্য শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র বলেছেন, ২০২২ সালের জুলাইয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রুপিতে বাণিজ্য করার সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর বাংলাদেশকে প্রস্তাব দেওয়া হয়। আরও ১৮টি দেশ রুপিতে বাণিজ্য করছে। বাংলাদেশ ১৯তম দেশ হিসেবে এটা শুরু করল।
তবে ডলারের ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর লক্ষ্য নিয়ে যে রুপিতে লেনদেন চালু, তার ফলে আসলে কতটা ডলার সাশ্রয় হবে?
কর্তৃপক্ষ বলছে, শতভাগ বাণিজ্য রুপিতে হবে না।
অর্থাৎ বাংলাদেশ ভারতে যতটা পণ্য রপ্তানি করবে, ততটাই কেবল রুপিতে লেনদেন হবে। এর বাকিটা মানে যা বাংলাদেশ আমদানি করে তার অর্থ শোধ করা হবে হবে ডলারে।
এর মানে হচ্ছে, দুই বিলিয়ন ডলারের পণ্যের দাম রুপিতে দেবে ভারত, যা বাংলাদেশ ভারত থেকে পণ্য কিনতে ব্যবহার করবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ভারতে বছরে প্রায় দুই বিলিয়ন বা দুইশো কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ।
এর বিপরীতে দেশটি থেকে আমদানি হয় প্রায় ১৪ বিলিয়ন বা ১৪০০ কোটি ডলারের পণ্য। অর্থাৎ বাণিজ্য ঘাটতি প্রায় সাত গুণ।
ফলে সাধারণভাবে ধারণা করা যায়, নতুন ব্যবস্থায় বাংলাদেশ তুলনামূলকভাবে কম মার্কিন ডলার সাশ্রয় করতে পারবে।
বাংলাদেশ এবং ভারতের ব্যবসায়ীরা এতোদিন স্থানীয় মুদ্রায় মার্কিন ডলার কিনে বাণিজ্যিক লেনদেন নিষ্পত্তি করতেন। কিন্তু রুপিতে বাণিজ্য হলে তার প্রয়োজন হবে না।
পোশাক রপ্তানিকারকদের অন্যতম সংগঠন বিকেএমইএ-এর নির্বাহী প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ হাতেম মনে করেন, এর ফলে বাংলাদেশের একটি বড় অংকের ডলার সাশ্রয় হবে এবং তাতে রপ্তানিকারক ও আমদানিকারকরা লেনদেনে লাভবান হবেন।
তিনি বলছেন, সরাসরি রুপিতে লেনদেনের ফলে অন্তত ছয় শতাংশ খরচ সাশ্রয় হবে ব্যবসায়ীদের।
তিনি বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে, “ভারতের সাথে বাণিজ্যের সময় একবার টাকা থেকে ডলারে, আবার ওদিকে রুপি থেকে ডলারে রূপান্তর করতে হয়। এই রূপান্তর করতে গিয়ে আমরা হিসেব করে দেখেছি ছয় শতাংশের মতো গ্যাপ বা লস হয়। অর্থাৎ ১০০ ডলারে ছয় ডলারের মতো। দুই দেশ নিজস্ব মুদ্রায় লেনদেন করলে ব্যাংক ও ব্যবসায়ীরা এই লস থেকে রেহাই পাবে।”
সেই সাথে একটি মাত্র মুদ্রার ওপর আমদানি-রপ্তানির নির্ভরশীলতা কিছুটা কমে আসবে বলে তিনি মনে করেন।
তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই বাণিজ্য শুধুমাত্র ভারতীয় রুপিতে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না, এই লেনদেন সুবিধা টাকায়ও চালু করতে হবে।
তিনি বলেন, শিগগিরই এই বাণিজ্যে টাকাও যুক্ত হবে বলে দুই দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের পক্ষ থেকে তাদের জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশ শুরুতে রুপি এবং টাকা উভয় মাধ্যমেই লেনদেনের জন্য আবেদন করেছিল। রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া তা অনুমোদনও করেছে।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন ভিন্ন কথা। এই উদ্যোগের ফলে ডলার সংকট বেড়ে যেতে পারে বলেও আশংকা করছেন কেউ কেউ।
পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলছেন, “যেহেতু বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে বড় ধরণের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে, সেজন্য রুপিতে লেনদেনে ডলার-সংকট কমবে না, বরং বাড়বে।”
তিনি বলেছেন, নতুন ব্যবস্থায় এই বাণিজ্যের ফলে বাংলাদেশ আগে যে দুইশো কোটি ডলার পেতো, সেটা এখন ভারত রুপিতে পরিশোধ করবে। ফলে বাংলাদেশ ওই পরিমাণ ডলার আর পাচ্ছে না। এতে ডলারের সরবরাহ কমে যাচ্ছে।
তিনি বলছেন, রুপিতে বাণিজ্যের সুযোগ আবার সব রপ্তানিকারকদের জন্য প্রযোজ্য হবে না। যে ব্যবসায়ীরা শুধুমাত্র ভারত থেকে কাঁচামাল আমদানি করে এবং ভারতেই রপ্তানি করে তারা হয়তো এই লেনদেনে কিছুটা সুবিধা পাবেন।
কিন্তু এতে ব্যবসায়ীদের যে লাভ হবে সেই লাভের অর্থ ডলারে রূপান্তর করা এবং সেখানে প্রকৃত দাম পাওয়া যাবে কিনা তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন মি. মনসুর। কেননা রুপির দাম ডলারের দামের মতো স্থিতিশীল নয়।
দৈনিক প্রথম আলোতে লেখা এক কলামে ভারত-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (আইবিসিসিআই) এর সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ বলেছেন, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাই টাকা-রুপির লেনদেনে বেশি উপকৃত হবেন।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের টাকা থেকে ডলার, তারপর ডলার থেকে রুপিতে বিনিময় করতে গিয়ে ৪-৬ শতাংশ অতিরিক্ত খরচ হয়। টাকা-রুপির লেনদেন চালু হলে এ খরচ বেঁচে যাবে। আবার ডলারে ঋণপত্র খুলতে ব্যবসায়ীরা একধরনের অনিশ্চয়তায় থাকেন। কারণ গত এক বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার মান ঘন ঘন কমেছে। কিন্তু টাকা-রুপির লেনদেনে সেই অনিশ্চয়তা সেভাবে নেই। কারণ, রুপির বিপরীতে টাকার মান তেমন একটা কমেনি।
সূত্র: বিবিসি বাংলা, প্রথম আলো