সৌদি আরব নয়, মে মাসে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক প্রবাসী শ্রমিক গেছেন মালয়েশিয়ায়

এতদিন পর্যন্ত শ্রম অভিবাসনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশিদের প্রথম পছন্দ ছিল সৌদি আরব। কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে মে মাসে মালয়েশিয়ায় সবচেয়ে বেশিসংখ্যক প্রবাসী শ্রমিক গেছেন। 

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, সাড়ে তিন বছরের বিরতির পর গত বছরের আগস্ট থেকে ফের বাংলাদেশি কর্মী নেওয়া শুরু করেছে মালয়েশিয়া। চলতি বছরের মে মাসে ৩৫ হাজার ১৯০ জন কর্মী নিয়েছে দেশটি। বিপরীতে সৌদি আরব মে মাসে বাংলাদেশ থেকে ২৯ হাজার ৬৬৭ জন কর্মী নিয়েছে।

কর্মী নিয়োগকারীরা বলছেন, তেলসমৃদ্ধ উপসাগরীয় দেশগুলোর তুলনায় মালয়েশিয়া তুলনামূলক ভালো বেতন কাঠামো দেওয়ায় দেশটিতে বেশিসংখ্যক কর্মী যাচ্ছেন।

লোভনীয় বেতনের পাশাপাশি মালয়েশিয়ার আবহাওয়া অনেকটা বাংলাদেশের মতোই। এই আবহাওয়া বাংলাদেশি কর্মীদের দেশটিতে যাওয়ার আগ্রহের পেছনে আরেকটি কারণ বলে জানিয়েছেন তারা।

তবে বছরওয়ারি হিসেবে এখনো সৌদি আরবই বাংলাদেশি শ্রমিকদের শীর্ষ গন্তব্য হিসেবে রয়ে গেছে। কিন্তু এই প্রথ মাসিক হিসেবে সৌদিকে ছাড়িয়ে মালয়শিয়া প্রথম স্থানে উঠে এলো। 

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অভ ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) যুগ্ম সম্পাদক মো. টিপু সুলতান বলেন, ‘সৌদি আরবে একজন বাংলাদেশি শ্রমিক সর্বনিম্ন বেতন পান ৮০০ থেকে ১০০০ সৌদি রিয়াল (প্রায় ২৩,০০০ থেকে ২৮,০০০ টাকা)। আর মালয়েশিয়ায় সর্বনিম্ন বেতন ১,৫০০ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত (৩৫,০০০ টাকা)। তাই স্বাভাবিকভাবেই মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার চালু হওয়ার পর বাংলাদেশি কর্মীরা এখন সেদিকে ঝুঁকছেন।’

‘তবে এই পরিস্থিতি বেশি দিন থাকবে না। মালয়েশিয়া নতুন করে বিদেশি কর্মী অনুমোদন দিচ্ছে না। মূলত আগে যাদেরকে অনুমোদন দিয়ে রেখেছিল, তারাই এখন  সে দেশে যাচ্ছেন,’ বলেন তিনি।

গত মার্চে মালয়েশিয়া পরবর্তী বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার আগপর্যন্ত বিদেশি শ্রমিকদের জন্য কোটার আবেদন ও অনুমোদন স্থগিত করেছে। দেশটির মানবসম্পদ মন্ত্রণালয় চলতি বছরের ১৮ মার্চ পর্যন্ত বিদেশি কর্মীদের জন্য ছয়টি খাতে—উৎপাদন, নির্মাণ, সেবা, বৃক্ষরোপণ, কৃষি, খনি ও গার্হস্থ্য সেবা—১১ লাখ ৩৬ হাজার ২২টি কর্মসংস্থান কোটা অনুমোদন করেছে।

মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন মালয়েশিয়ার শ্রম বিভাগ এ পর্যন্ত ৪.২৭ লাখ নতুন বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগের অনুমোদন দিয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ২ লাখ কর্মী ইতিমধ্যেই মালয়েশিয়ায় আছেন। মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশন জানিয়েছে, বাকি ২.২৭ লাখ কর্মী দেশে অভিবাসনের প্রক্রিয়াধীন রয়েছেন।

বাংলাদেশ হাইকমিশন আশা করছে, অভিবাসনের এই ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা অব্যাহত থাকলে আগামী দুই-তিন বছরের মধ্যে মালয়েশিয়া প্রায় ৫ লাখ নতুন বাংলাদেশি কর্মী নেবে।

একটি বেসরকারি হিসাব অনুযায়ী, মালয়েশিয়ায় প্রায় ১০ লাখ বাংলাদেশি বসবাস করে। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অসদাচরণ এবং চড়া নিয়োগ ব্যয়ের অভিযোগে দেশটি ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশি কর্মীদের নিয়োগ স্থগিত করে।

বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য শ্রমবাজার উন্মুক্ত করে দিতে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া ২০২১ সালের ১৯ ডিসেম্বর একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করেছে।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্যানুসারে, ১.০১ লাখ বাংলাদেশি বিদেশে চাকরি পাওয়ায় মে মাসে বৈদেশিক কর্মসংস্থান বেড়েছে; যা এপ্রিলের চেয়ে ২৮ শতাংশ বেশি।

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত বিভিন্ন দেশ প্রতি মাসে গড়ে এক লাখ করে পাঁচ মাসে মোট ৫.০৩ লাখ বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগ করেছে।

এর মধ্যে সৌদি আরব সর্বোচ্চ ১.৮৬ লাখ, মালয়েশিয়া ১.৩৬ লাখ, ওমান ৬৮ হাজার, সংযুক্ত আরব আমিরাত ৩৬ হাজার ও সিঙ্গাপুর ২১ হাজার বাংলাদেশি কর্মী নিয়েছে। 

করোনা মহামারির আগে বাংলাদেশ প্রতি মাসে গড়ে ৬০ হাজার থেকে ৭০ হাজার কর্মী বিদেশে পাঠাত। ২০২০ সালে এ সংখ্যা কমে যায়। তবে ২০২২ সালে ফের বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগ বৃদ্ধি পায়—ওই বছর বাংলাদেশ থেকে রেকর্ড ১১.৩৫ লাখ কর্মী বিদেশে যান। 

অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বিদেশে আরও বেশিসংখ্যক দক্ষ কর্মী পাঠানোর ওপর জোর দিলেও বিশ্ব শ্রমবাজারে বাংলাদেশকে এখনও অদক্ষ শ্রমিকের উৎস হিসেবেই দেখা হয়। বাংলাদেশিরা সৌদি আরবে পরিচ্ছন্নতাকর্মী, নির্মাণ শ্রমিক ও গৃহকর্মীর মতো স্বল্প বেতনের চাকরি পান।

গত পাঁচ-ছয় বছর ধরে বাংলাদেশি অভিবাসীদের শীর্ষ গন্তব্য সৌদি আরব। একটি বেসরকারি হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে প্রায় ২৮ লাখ বাংলাদেশি দেশটিতে কাজ করছেন।

এছাড়া এতদিন সৌদি আরব থেকেই সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় আসত। তবে সম্প্রতি রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে সৌদি আরবকে দ্বিতীয় অবস্থানে ঠেলে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম স্থানে উঠে এসেছে।

কম প্রবাসী বাংলাদেশি থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র এখন বাংলাদেশের জন্য শীর্ষ রেমিট্যান্সের উৎস দেশে পরিণত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি কর্মীর সংখ্যা দুই লাখের কিছু বেশি।

এখনও উদ্বেগের বিষয় উচ্চ অভিবাসন ব্যয়

বাংলাদেশি কর্মীদের মধ্যে মালয়েশিয়া ও সৌদি আরব, এ দুই দেশে যাওয়ার প্রবণতা বেশি। তবে এখনও উচ্চ অভিবাসন ব্যয় বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য বড় উদ্বেগের বিষয়।

প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ৭৯ হাজার টাকা খরচ নির্ধারণ করে দিলেও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মালয়েশিয়াগামী এক কর্মী টিবিএসকে বলেন, রিক্রুটিং এজেন্সিকে ৪ লাখ টাকার বেশি দিতে হয়েছে তার।

এছাড়া সরকার সৌদিগামী শ্রমিকদের জন্য অভিবাসন ব্যয় ১.৬৫ লাখ টাকা ঠিক করে দিলেও অনেক শ্রমিক দাবি করেছেন, অভিবাসনের জন্য তাদের প্রায় ৩-৪ লাখ টাকা দিতে হয়।

বর্তমানে মাত্র ১০০টি বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সিকে গন্তব্য দেশের অনুমোদন অনুযায়ী মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর অনুমতি দেওয়া হয়, যা সিন্ডিকেট সিস্টেম নামে বহুল পরিচিত।

রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট-এর (রামরু) মতো অভিবাসন থিঙ্কট্যাঙ্কগুলো মালয়েশিয়ায় উচ্চ অভিবাসন ব্যয়ের জন্য এই ‘দুর্নীতিগ্রস্ত সিন্ডিকেট সিস্টেম’কে দায়ী করেছে।

সূত্র: দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড

About The Author

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *