বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠছে হুন্ডি। অত্যন্ত রক্ষণশীলভাবে হিসাব করে দেখা গেছে, দেশে হুন্ডি-হাওলার বাজার এখন ৩০-৩৫ বিলিয়ন (৩ হাজার থেকে সাড়ে ৩ হাজার কোটি) ডলার ছাড়িয়েছে। যদিও অর্থনীতিবিদরা বলছেন এই পরিমাণ আরও অনেক বেশি হবে।
দেশে আন্তর্জাতিক পণ্য বাণিজ্যে হুন্ডি-হাওলার মাধ্যমে লেনদেনকৃত অর্থের পরিমাণ কমপক্ষে ১৫ বিলিয়ন ডলার। রেমিট্যান্স হিসেবে আসছে আরো ১০ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া দুর্নীতি ও কালোবাজারির মাধ্যমে অবৈধ অর্থ পাচার, স্বর্ণ ও অন্যান্য পণ্য চোরাচালান, মানব পাচারের মতো কার্যক্রমে হুন্ডি-হাওলার অবদান ৫ থেকে ১০ বিলিয়ন ডলার।
সারা দেশের মধ্যে চট্টগ্রামেই হুন্ডি কারবার বেশি। দেশে ভোগ্যপণ্যের আমদানি বাজার নিয়ন্ত্রণ হয় চট্টগ্রাম থেকে। আবার এখানকার প্রচুর মানুষ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শ্রমবাজারে নিয়োজিত রয়েছে। বাড়তি সুবিধার আশায় তাদের অনেকেই এখন দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন হুন্ডির মাধ্যমে। এখানকার প্রচুর ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে পণ্য বাণিজ্যে হুন্ডি-হাওলায় লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে। আবার ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া অর্থ কোথাও বিনিয়োগ না করে হাওলার মাধ্যমে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়ার অভিযোগও চট্টগ্রামেই সবচেয়ে বেশি। খোদ স্থানীয়রাই বলছেন, চট্টগ্রামে হুন্ডি-হাওলার কারবার বিস্তৃত হয়েছে দেশের অন্য যেকোনো অঞ্চলের চেয়ে বেশি। বিষয়টিতে দ্বিমত পোষণ করছেন না ব্যাংকাররাও।
এক্সিম ব্যাংকের অতিরিক্ত উপব্যবস্থাপনা পরিচালক এসএম জাকের হোসেন বলেন, ‘চট্টগ্রামের মানুষ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রবাসী হিসাবে কাজ করলেও সেই অনুপাতে রেমিট্যান্স আসেনি। এখানে হুন্ডির আধিক্যের অভিযোগটি অমূলক নয়। গ্রামাঞ্চলের চেয়ে শহরে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ তুলনামূলক কম। বাণিজ্য, আমদানি-রফতানিসহ নানা কারণে এখানকার মানুষের ব্যাংকবহির্ভূত চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানোর সুযোগ থাকে বেশি। তাৎক্ষণিক লাভের আসায় প্রবাসীদের অনেকেই হুন্ডির দ্বারস্থ হচ্ছেন।’
চট্টগ্রামের হুন্ডি-হাওলার কারবার সম্প্রসারিত হয়েছে প্রধানত রিয়াজউদ্দিন বাজার, টেরিবাজার কিংবা দেশে ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জকে ঘিরে। এখান থেকে ব্যবসা শুরু করে হুন্ডি বাণিজ্যের মাধ্যমে শত কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া একাধিক ব্যক্তির নাম স্থানীয় ব্যবসায়ী মহলে বেশ আলোচিত। পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক সংস্থার কাছেও চট্টগ্রামের বেশকিছু ব্যবসায়ীর নাম রয়েছে, যারা হুন্ডির মাধ্যমে ব্যবসা করে কোটিপতি হিসেবে পরিচিত পেয়েছেন। এসব ব্যবসায়ীদের অনেকেই হুন্ডিসহ অর্থ পাচারের মামলায় পলাতক রয়েছেন।
আরও পড়ুন: দেশে হুন্ডি-হাওলার বাজার ৩০-৩৫ বিলিয়ন ডলার
চট্টগ্রাম কাস্টমসসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম কাস্টমসের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে অর্থ পাচারের ঘটনায় ১২০টির মতো মামলা চলমান রয়েছে। এছাড়া পাঁচ হাজারের বেশি আমদানি-রফতানির ঘটনার সঙ্গে অর্থ পাচারের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে সন্দেহ করছে চট্টগ্রাম কাস্টমস। এ নিয়ে তদন্তও হচ্ছে। আর্থিক খাতসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ওভার ও আন্ডার ইনভয়েসিং ছাড়াও ঘোষণাবহির্ভূত পণ্য আমদানির মাধ্যমেও অর্থ পাচার করা হচ্ছে। এ অর্থ পাচার হচ্ছে হুন্ডি বা হাওলার মাধ্যমে।
কোনো ধরনের এলসি ছাড়াই পণ্য আমদানির নজিরও রয়েছে। জাপান থেকে ‘মালয়েশিয়া স্টার’ নামের একটি জাহাজে করে ৮৭২টি গাড়ি বাংলাদেশে আনা হয় গত বছরের নভেম্বরে। চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরে জাহাজ থেকে গাড়িগুলো খালাস করা হয়। ওই সময় অভিযোগ ওঠে এসব গাড়ির উল্লেখযোগ্যসংখ্যকই আনা হয়েছিল এলসি ছাড়া।
বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি চট্টগ্রামে। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসায় না খাটিয়ে বিদেশে পাচার, পালিয়ে যাওয়ার অভিযোগ এখানেই পাওয়া যায় সবচেয়ে বেশি। একসময় এখানকার ব্যবসায়ীদের উদারহস্তে ঋণ বিতরণ করেছে ব্যাংকগুলো। এসব ব্যবসায়ীর অনেকেই কানাডা-অস্ট্রেলিয়া-মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে পালিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। মূল ব্যবসার বাইরে কাগুজে প্রতিষ্ঠান তৈরি করে ঋণ গ্রহণ ও তা বিদেশে পাচারের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন অনেকে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, অর্থ পাচার কিংবা বিদেশ থেকে অর্থ আনতে অভিযুক্ত ব্যবসায়ীদের অনেকেই হুন্ডি-হাওলার দ্বারস্থ হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘হুন্ডি বা হাওলার পরিমাণ যদি আমাদের রিজার্ভের আকারের চেয়ে অনেক বেশি হয়ে যায়, তাহলে করণীয়ও অনেক কঠিন হয়ে পড়বে। সুশাসনের উন্নতি না হলে দুর্নীতি বাড়ে। আর দুর্নীতিগ্রস্ত পরিস্থিতির যদি উন্নতি না হয়, রাজনৈতিক জবাবদিহিতা যদি না থাকে, তাহলে টাকা কীভাবে থাকবে? যারা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ সম্পদ অর্জন করেছে তারা দেখে টাকাটা কোথায় নিরাপদ। এমন বহু কারণে টাকা চলে যাচ্ছে। এটাকে ঠেকানো অনেক কঠিন।’
সৌজন্যে: বণিক বার্তা