এই লেখায় আমরা এমন কিছু সাধারণ আর্থিক ভুলের দিকে নজর দেব যা প্রায়ই মানুষকে বড় অর্থনৈতিক দুর্দশায় ফেলে দেয়। আপনি যদি এরই মধ্যে আর্থিক দুরবস্থা পড়ে থাকেন, তাহলেও এই ভুলগুলো এড়াতে পারলে আপনি দ্রুত এই দুরবস্থা থেকে মুক্তি পেতে পারেন।
১. অতিরিক্ত খুচরা খরচ
ছােট বালুকার কণা, বিন্দু বিন্দু জল, গড়ে তােলে মহাদেশ, সাগর অতল- পংক্তিদ্বয়ের মতো ব্যক্তিগত আর্থিক ব্যবস্থাপনায়ও ছোট ছোট খরচ এড়িয়ে চলা উচিত। অনেক সময় ছোটখাটো খরচকে আমরা তেমন একটা গুরুত্ব দেই না। কিন্তু এই খরচগুলো জমা হতে হতে একটা বড় অংকে পরিণত হয়। সামান্য দূরত্বে রিকশায় যাওয়া, নিয়মিত বাইরে খাওয়া, অনেকগুলো স্ট্রিমিং সার্ভিসের সাবসক্রিপশন কেনা কিংবা ফ্রি বিকল্প থাকা সত্বেও কোনো কিছুর জন্য অর্থ খরচ করা- ইত্যাদি নানা খরচ মাস শেষে বড় খরচে পরিণত হয়।
সপ্তাহে যদি ২ হাজার টাকাও আমরা বাইরে খাওয়ার পেছনে ব্যয় করি, তাহলে বছর শেষে মোট খরচ দাঁড়ায় ১ লাখ টাকারও বেশি। ছোট এসব খরচ আপনার জীবনযাত্রার উপর বাড়তি চাপ তৈরি করে। খুটিনাটি খরচ যথাসম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করুন।
২. দীর্ঘ সময় ধরে কিস্তি পরিশোধ
ঝোঁকের মাথায় আমরা অনেক সময় আপাত লোভনীয় পণ্য বা সেবা কিনি। এতে অনেক খরচ হলেও যেহেতু মাসিক কিস্তিতে তা পরিশোধের ব্যবস্থা থাকে, তাই খরচটা আমাদের সেভাবে প্রথমদিকে গায়ে লাগে না। এরকম কিছু কেনার আগে নিজেকে ভালোভাবে জিজ্ঞেস করুন এই পণ্যটির জন্য মাসের পর মাস বা বছরের পর বছর ধরে কিস্তি পরিশোধ করাটা যথার্থ কিনা। ক্যাবল টিভি সাবসক্রিপশন, মিউজিক সার্ভিস, অত্যাধুনিক জিমনেসিয়াম ইত্যাদির পেছনে আপনি হয়তো প্রতি মাসে মাসে অর্থ পরিশোধ করছেন, কিন্তু আপনি এগুলো থেকে কতটা উপকৃত হচ্ছেন, আদৌ এগুলো নিয়মিত ব্যবহার করছেন কিনা, সেটি আবার পর্যালোচনা করুন। আবার দেখা গেলো খুব শখ করে আপনি খুব দামি একটি কিছু কিনলেন। কিন্তু কয়েকদিন পরই সেই শখ ফুরিয়ে গেলো। আপনাকে কিন্তু তখনও সেই পণ্যের অর্থ পরিশোধ করে যেতে হবে। তাই ঝোঁকের মাথায় কোনো কিছু কেনা থেকে বিরত থাকুন। দামি কিছু কেনার আগে সময় নিন, ভালো কেরে ভাবুন। আয়ের পরিমাণ যদি সীমীত থাকে এবং আপনার যদি আরও অর্থ সঞ্চয়ের ইচ্ছা থাকে, তাহলে এসব খরচ এড়িয়ে চলুন।
৩. ধারের টাকায় চলা
নিত্যপ্রয়োজনী পণ্য কেনায় ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার এখন একেবারে সাধারণ ব্যাপার হয়ে গেছে। কিন্তু এক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। ক্রেডিট কার্ডের সুদের হার অনেক বেশি। দেখা গেলো আপনি সংসারের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনলেন ১০ হাজার টাকার। কিন্তু সময়মতো অর্থ পরিশোধ না করার কারণে আপনাকে পরবর্তীতে ১২ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হলো। এটা তখন মোটেও ভালো সিদ্ধান্ত হবে না। এর বাইরেও ধারের টাকায় চলা বন্ধ করতে সর্বাত্নক চেষ্টা করুন। জীবনযাত্রাকে নিজের উপার্জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখুন।
৪. গাড়ি কেনার ক্ষেত্রে সতর্ক না হওয়া
বিশ্বজুড়ে প্রতি বছর লাখ লাখ গাড়ি বিক্রি হয়। খুব কম সংখ্যক ক্রেতাই নগদ অর্থে এসব গাড়ি কেনেন। বেশিরভাগ গাড়ি বিক্রি হয় কিস্তিতে অথবা ধার করা অর্থে। নগদ অর্থে গাড়ি কিনতে পারছেন না, তার মানে আপনার গাড়ি কেনার আর্থক সামর্থ নেই। মাসে মাসে পেমেন্ট করার সামর্থ আর গাড়ি কেনার সামর্থ এক কথা নয়।
অনেকে আবার ধার করে গাড়ি কেনেন। বিভিন্ন সুদ ও খরচ হিসাব করলে দেখা যাবে গাড়ির মূল খরচের তুলনায় আপনি অনেক বেশি অর্থ খরচ করেছেন। অনেকে আবার প্রতি ২-৩ বছর পর পর নিজের গাড়িটি বিক্রি করে দেয়। তখনও অনেক কম দামে বিক্রি করতে হয়, ফলে আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হন। অনেক সময় মানুষ পরিবার বা ব্যবসার জন্য বাধ্য হয়েই ঋণ নিয়ে গাড়ি কেনেন। সেক্ষেত্রেও দেখা উচিত কোন গাড়িটি কিনলে আপনার কাজ সারবে। বিনা কারণে দামি ও বড় গাড়ি কেনার দরকার নেই। দামি গাড়ির পরিচালন খরচও বেশি। যেসব গাড়ির জ্বালানি ও মেনটেইন্যান্স খরচ কম, এমন গাড়ি কেনার চেষ্টা করুন। প্রয়োজনের বাইরে বেশি দামি গাড়ি কেনা মানে অর্থের অপচয়।
৫. বাড়ির পেছনে অতিরিক্ত খরচ করা
সবাই বড় বাড়ি কেনার চেষ্টা করেন। কিন্তু বড় বাড়িই যে সবসময় ভালো- এমনটা নাও হতে পারে। আপনার পরিবার আন্দাজে বাড়ি কিনুন। বাড়ি যত বড় হবে, ট্যাক্স, ইউটিলিটি ও অন্যান্য খরচও তত বেশি হবে। আপনি নিশ্চয়ই চাইবেন না প্রতি মাসের বেতনের একটি বড় অংশ বাড়ির কিস্তির পেছনে ব্যয় করতে।
৬. অবসরের জন্য সঞ্চয় না করা
আপনি যদি নিজের জন্য সঞ্চয় না করেন, বা আয় বাড়ায় এমন কোনো বিনিয়োগের মাধ্যমে আপনার অর্থকে কাজে লাগাতে না পারেন, তাহলে আপনাকে হয়তো আজীবনই কাজ করতে হতে পারে। নিরাপদ অবসরের জন্য প্রতি মাসে নির্দিষ্ট পরিমান অর্থ সঞ্চয় করুন। আবসরের অর্থ যে ফান্ডে জমা রাখবেন, সেই একাউন্ট বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও ভালোভাবে পর্যালোচনা করে নিন। অনেক সময় এসব অবসর ফান্ড রাখার একাউন্টে ট্যাক্স ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা বেশি থাকে। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ কারও পরামর্শ নিন।
৭. কোনো আর্থিক পরিকল্পনা না থাকা
আপনার আর্থিক ভবিষ্যত বর্তমানে যা ঘটছে তার উপর নির্ভর করে। লোকেরা টিভি দেখা বা সামাজিক মিডিয়াতে স্ক্রোল করে অসংখ্য ঘণ্টা ব্যয় করে, কিন্তু তাদের আর্থিক বিষয়ের জন্য সপ্তাহে দুটি ঘণ্টা সময় বের করা অকল্পনীয়। আপনাকে জানতে হবে আপনি কোথায় যাচ্ছেন। আপনার আর্থিক পরিকল্পনায় কিছু সময় ব্যয় করাকে অগ্রাধিকার দিন।
বর্তমানে কি হচ্ছে, তার উপর আপনার ভবিষ্যতের আর্থিক সাফল্য নির্ভর করে। এখন যদি সঠিক পরিকল্পনা না করেন, তাহলে ভবিষ্যতে ভুগতে হবে। ঘন্টার পর ঘন্টা টিভি দেখে বা সোশ্যাল মিডিযার পেছনে নষ্ট না করে সপ্তাহে অন্তত ২ ঘন্টা আর্থিক পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার জন্য ব্যয় করুন। আর্থিক দিক দিয়ে আপনি কোন অবস্থায় আছেন, সে সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা রাখুন। ভবিষ্যত পরিকল্পনার পেছনে সময়দিন।
অত্যধিক খরচের বিপদ এড়াতে প্রথমে ছোট খরচগুলি পর্যবেক্ষণ করা শুরু করুন এবং এরপর বড় বড় খরচের দিকে নজর দিন। বড় খরচ করার আগে ভালোভাবে সবদিক বিবেচনা করুন। মাসিক কিস্তির তালিকায় নতুন খরচ যোগ করার আগে সাধাবন ও সতর্ক হোন। সঞ্চয় ও পরিকল্পনার দিকে মনোযোগ দিন।